৬০ বছরের বৃদ্ধ বাবার মাথায় একের পর এক বস্তা তুলে দিচ্ছি। ইচ্ছা করছে এক সাথে দুইটা করে বস্তা তুলে দেই। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বৃদ্ধ বাবা বসে পরতেই মেজাজ তীব্র আকার ধারন করল।কারন ওদিকে রতন আমার জন্য জুয়ার বোর্ডে বসে অপেক্ষা করছে। কিন্ত বস্তা আনলোডের জন্য আমি যেতে পারছি না। বস্তা আনলোডের কাজ বাবা একাই করে, আমি আজ প্রথম আসলাম। বাবার সাথের লোকটা আজ কাজে আসেনি তাই। সে আসলে হয়ত বাবা আর সে দুই জনে ভাগে এই বস্তা গুলা গাড়ি থেকে আনলোড করত। কিন্ত আজ সে না আসায় বাবা তার সাথে আমাকে নিয়ে আসছে।কারন একদিনের কাজ বন্ধ হলে ঘরের চুলার আগুনের তাপে খালি পাতিল পোড়ানো ছাড়া আমার মায়ের আর কোন উপায় থাকবে না।
কিন্ত আমি এসব পাতিলের খবর রাখি না।এক বেলা খাই ত দুই বেলা না খেলেও চলে। আমার ত শুধু ঐ দিনে ৫০ টাকার গাজা আর জুয়া খেলার জন্য এক দেড়শ টাকা হলেই হয়ে যায়।
বিরক্ত নিয়ে তারাতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য বাবাকে বসে পরতে দেখে, নিজেই একটা বস্তা মাথায় তুলে দুই পা বাড়াতেই ঘাড়ের সব থেকে তেড়া রকটা কট করে শব্দ করল।আর এদিকে বস্তার ভারে ঘাড়টা নিচের দিকে গেথে যাওয়ার উপক্রম। চোখ দিয়ে নিমিশেই পানি ঝড়তে লাগল দূর থেকে বাবার তা দেখে দৌড়ে এসে ঘাড় থেকে বস্তাটা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে জিজ্ঞাস করল,বাবা ব্যথা পাইছিস? তুই কেন বস্তা মাথায় নিতে গেলি?
এসব কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ বাবার কুচকানো চামড়া চোখের পানিতে ভিজে গেছে। বৃদ্ধ মানুষ টার এই চোখের পানি আমার ভিতরটা দুমরে মুচড়ে দিচ্ছিল।দুই চোখের পানি যেন আমাকেও ভিজাতে চাচ্ছে।এদিকে বাবা সাথে সাথে এদিক ঐদিক ছুটাছুটি শুর করে দিল।দৌড়ে গিয়ে মদি দোকান থেকে আইসক্রিম এনে আমার ঘারে চেপে ধরল।বৃদ্ধ মানুষটা এই বয়সে ফুসলে ফুসলে কাদছে আমার মত একটা অপদার্থ ছেলের জন্য তা ভাবতেই বুকের ভিতরটা হাহা কার করে উঠল।
দুই হাত দিয়ে বাবার চোখের পানি মুশতে গিয়ে বাবার পায়ের দিকে নজর পরল।দেখি পায়ের আংগুল ফেটে তাজা রক্ত বের হচ্ছে।তারাতাড়ি হাত দিয়ে পা চেপে ধরে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,,
একটু আগেও ত পা ঠিক ছিল এখন পা টা কাটলে কিভাবে?এতক্ষন কাদতে থাকা মানুষ টা আমার মুখে এমন কথা শুনে, একটা মুশকি হাসি দিয়ে বলল তোর জন্য বরফ আনার সময় কিসে যেন উষ্ঠা লাগছিল।তখন হয়ত কেটে গেছে।বাবার মুখে এমন কথা শুনে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।নিজের পায়ের নখ উঠে অঝোরে রক্ত পরছে কিন্ত সে তা বুজতেই পারেনি। ছেলে ঘারে ব্যথা পাইছে এই ভয়ে বাচ্চাদের মত কাদছে। আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলাম।কাদতে কাদতে বাবাকে বললাম,বাবা গো রাতে ঘুমাইছ কিনা,দুপুরে খাইছ কিনা, তোমার কিছু লাগবে কিনা,কিছুই ত কোন দিন ও জিজ্ঞাস করিনি। তবু কেন এই অপদার্থ ছেলের জন্য এই বয়সে কাদছ বাবা?
বাবাগো আমি ত ঘারে ব্যথা পাইনি, ব্যথা পাইছি কলিজায়, যে কলিজাটা নেশার কালো ধুয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যে নেশা বাবা মা কি তা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।বাবা বস্তা টা মাথায় নিয়ে আমি এটা ভেবে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিছিলাম আমার মত ২৪ বছরের ছেলে এই বস্তা মাথায় নিয়ে মনে হচ্ছিল ঘার টা ভেংগে যাবে। সেখানে আমি এতক্ষন কত বড় কুলাংগার হয়ে এত ভারি বস্তাটা তোমার মাথায় তুলে দিচ্ছিলাম।
বাবা তুমি যখন কান্ত শরিল নিয়ে বসে পড়লে।আমি তখন এটা ভাবিনি যে বাবার ঘাম টা মুছে পাশে দাঁড়িয়ে একটু বাতাস করি।বাবা আমার মাথায় ত তখন বাংলাদেশের খেলায় প্রতি বলে বাজি ধরে টাকা জিতার চিন্তা ঘুরছিল।যদি এই বস্তা টা আরো আগে মাথায় নিতাম,তাহলে এই অপদার্থ ছেলেটা হয়ত গাজার ধোয়ায় সুখ না খুজে তোমার পায়ের কাছে সুখ খুজে পেত। আমার এই কান্না জরিত কথা গুলা বাবার কলিজায় গিয়ে আঘাত করছে হয়ত, তাই আমাকে এত শক্ত করে জরিয়ে ধরছে যে নিজের ভিতরে নিয়ে যাবে। বাপ ছেলে রাস্তায় বসে হাউমাউ করে কাদছি। তা দেখে দারিয়ে থাকা রাস্তার মানুষ গুলাও নিজেদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। তাদের চোখের কোনেও জল গড়িয়ে পরছে। বাবা যে কি জিনিস তা আজ বুজলাম।
নিজের মনকে নিজেই বললাম অনেক হইছে এবার থেকে পরিবারের দায়িত্ব আমি নিব।বাবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললাম।বাবা তুমি দূরে গিয়ে বস আমি গাড়ি থেকে বস্তা আনলোড করব। আমার কথা কোন ভাবেই বাবা মানতে চাচ্ছিল না। পরে রাস্তার দারিয়ে থাকা সেই মানুষ গুলা চোখ মুছতে মুছতে বলল ভাই ওকে বস্তা মাথায় নিতে দেন। ওর নিজের পায়ে দাড়ানো দরকার। সবার জোড়াজুড়িতে তে বাবা রাজি হলেও মন থেকে পুরটা মেনে নিতে পারেনি। আমার মাথায় বস্তা তুলে দিয়ে পিছন থেকে বস্তা এক কোনা ধরে পিছে পিছে হাটছে বৃদ্ধ বাবা। বাবার এই কান্ড দেখে ভাবছি হায়রে বাবা, ২৪ বছরের ছেলের মাথায় বস্তা তুলে দিয়ে ও ব্যথা পাবার ভয়ে বস্তার পিছন ধরে রাখ। আর ৬০ বছরের বাবার মাথায় বস্তা তুলে দিয়ে আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে জুয়ার কথা ভাবি। এটাই হয়ত বাপ ছেলের মাজে পার্থক্য।
বাবা যাতে বস্তা না ধরে তাই বুদ্ধি করে বাবাকে বললাম, আমার জুতাটা দামি বস্তা টানতে গিয়ে ছিরে যাবে। তুমি তোমার জুতাটা আমাকে দিয়ে গাছের নিচে গিয়ে বস।বাবা কথাটা শুনে সাথে সাথে জুতাটা খুলে আমাকে দিয়ে দিল ঠিকি কিন্ত বস্তার ধরা বন্ধ করল না। গরম উওপ্ত বালিতে খালি পায়ে হাটছে তবু এত বলা সত্ত্বেও বস্তা পিছন ধরা ছারছে না। একটু পর পায়ের তলায় খোচা লাগছে দেখে জুতাটা হাতে নিলাম।দেখি চারপাশে সিলাই করা জুতাটা হার মানে নেয়ায় পরেও একের পর এক পেরেক গাথা হয়েছে তাতে।তার মধ্যে একটা পেরেক একটু উপরে উঠে আছে। কিন্ত এতটাই অবাক হলাম এগুলা জুতার পেরেক না। এগুলা একটাও জুতার পেরেক না সব গুলা কাঠের দোকানের হাফ ইঞ্চি পেরেক।বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম। বাবা কোন মুচিকে দিয়ে জুতা পেরেক মারাইছ। এগুলা ত কাঠের পেরেক। বাবা আমার কথা শুনে আবারও মুশকি হাসি দিয়ে বলল,মুচি দিয়ে সেলাই করিনি রে,আমি কাঠের দোকান থেকে কয়টা পেরেক চেয়ে নিজেই মারছি। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে কি লাভ বল? বাবার এই হাসি আমার ঈদে নতুন জুতা কিনার জন্য বাবা মায়ের সাথে খারাপ আচরনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে কলিজায় গিয়ে আঘাত করল, টান দিয়ে বাবার সেই পেরেক পিটানো হাত টা চুমু খেতে গিয়ে দেখি একের পর এক ঠোসায় পুরা হাতের তালু ক্ষত বিক্ষত। আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না বাবার পা জরিয়ে ধরে কেদতে লাগলাম। বাবা ও কাদতে কাদতে বসে পরে আমাকে জিজ্ঞাস করল কাদিস কেন বোকা ছেলে। এগুলা কিছু না রে। এই সামান্য হাতে ফোসকা পরেছে।ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে আজ নিজেরি গলা টিপে হত্যা করতে ইচ্ছা করছে। চোখের পানি মুছে তারাতাড়ি বস্তা আনলোড করে বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। আর মায়ের থেকে জুয়া খেলার জন্য আনা দেড়শো টাকা মধ্যে ১২০ টাকা দিয়ে এক জোড়া জুতা কিনলাম বাবার জন্য। আর ২০ টাকায় মায়ের জন্য হাত ব্যথা আর গেস্টিকের টেবলেট কিনলাম।সারা দিনের ক্লন্ত শরিল এখন খুব খেতে চাচ্ছে।পকেটের ১০ টাকা দিয়ে ঝাল মুড়ি কিনে মুখে দিতে যাবো মায়া ভরা ছোট বোনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর খেতে পারলাম না।বাসার দিকে হাটা দিলাম।
পকেটে থাকা ফোন টা আবার বেজে উঠল দেখি রতনের ফোন। কল টা কেটে দিয়ে নাম্বার টা ব্লক করে দিলাম। আর মনে মনে বললাম রতন রে আমি আলোর পথ খুজে পাইছি।তাই আমাকে আর তুই খারাপ কাজে খুজে পাবি না। বাসার সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই ছোট বোন দরজা খুলে দিল। হাতে থাকা মুড়ির ঠোংগাটা ওর হাতে দিতেই রাজ্যে জয়ের হাসি দিয়ে বলল,ভাইয়া আমার জন্য মুড়ি আনছিস।বোনটা মুড়ি হাতে নিয়ে এক মুঠ মুখে দিয়ে কাদতে লাগল।বললাম কাদিস কেন পাগলি?যদি জানতাম ওর উওর টা এমন হবে তাহলে হয়ত ভুলেও এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতাম না। ও বলল,জানিস ভাইয়া কত দিন ১০ টাকার ঝাল মুড়ি কিনে খাই না। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে, মা কাছে টাকা চাইতে গিয়ে যখন মনে পরত, মা টাকার অভাবে একটা ব্যথার ঔষধ কিনে না খেয়ে সারা রাত ব্যথায় ছটফট করে। তখন ঝাল মুড়ি না খেয়েই পেট ভরে যেতো রে ভাইয়া। ছোট বোনের মুখে এমন কথা শুনে চোখের কোন বেয়ে আবারো জল গড়াতে লাগলো। পাগলিটা আমার চোখ মুছে দিতে দিতে মুশকি হাসি দিয়ে বলল কিনা আরে ভাইয়া কাদিস কেন? তোকে মুড়ির ভাগ দিব ত একা একা খাব না। পাগলিটার মুখে এই কথা শুনে হেসে দিলাম। ঘরে ডুকে বাবার হাতে ১২০ টাকার জুতাটা দিতেই বাবা সে কি খুশি। ৬০ বছরের বাবা তার জন্য আমি জুতা আনছি দেখে ৬ বছরের বাচ্চাদের মত জুতাটা বার বার উল্টে পাল্টে দেখছে আর ঘরের মধ্যেই জুতা পরে হাটা শুর করে দিয়েছে। বাবার এমন কান্ড দেখে মা যেন হাসতে হাসতেই চোখ মুছছে আচল দিয়ে। উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে মনে মনে জিজ্ঞাস করলাম, এ কেমন কান্না কাদাচ্ছ খোদা। যত কাদি ততই কলিজায় শান্তি লাগে। মায়ের হাতে ঔষধ গুলা দিয়ে ঘরের দিকে দৌড় দিলাম। ওজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ শেষ করে খোদার কাছে দুইটা হাত তুলে মোনাজাতে কাদতে কাদতে বলতে লাগলাম,,,,
""""ও মালিক,কান্নায় যে এত মজা,আগে জানতাম না"
0 Comments